তৃষ্ণা

 

এ বছর মনে হয় শীত পড়বে বেশ। কার্তিকের শেষ। এখনই শীতের এমন আভাস ! পৌষ-মাঘ তো পড়েই আছে। একেতো ঠান্ডা, তার উপর যুক্ত হয়েছে ফ্যানের বাতাস। মাথার উপর ভনভন করে ঘুরছে সিলিং ফ্যান। ফ্যান না ছেড়ে ঘুমাতে পারে না বউ। গরম লাগে তার। ঘেমে এক্কেবারে নেয়ে উঠে। সারা বদনে শুধু তেল আর তেল। ওজনে একটা হাতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। প্রায়ই ঘোষণা দিয়ে খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দেয়। কিন্তু লাভ হয় না। ওজন কমে না। বিফল কষ্ট। বউটার এমন কষ্ট দেখে মায়া লাগে। শীতে কাঁপে সে। তবু ফ্যান ছাড়তে মানা করে না বউকে। পারস্পরিক বুঝাপড়ার যুগলবন্দী জীবন। স্যাক্রিফাইস থাকতেই হয়।  

 

ভারী একটা কম্বলে লাশমোড়া হয়ে ঘুমিয়ে আছে বসন্ত ডোম। সকাল হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবু ঘুম ভাংগে না তার। শীতের এই সকালটা ঘুমোতে বেশ আরাম আরাম লাগে। তাছাড়া, গতরাতে পেটে তরল একটু বেশিই পড়ে গেছে। একটানে পুরো বোতল সাবাড়। মাতাল হয়নি বটে। এর আগেই গলা উপচে নাড়িভুঁড়িসহ বেড়িয়ে এসেছে। শরীরটা বেশ নিস্তেজ বোধ করছিলো। মাথা অবধি কম্বল টেনে কোন এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছে। টানা ঘুম। মরার মতো। এই সাতসকালে একটা বিড়াল বাচ্চা মিউ মিউ করে ডাকছে। হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। বউ মনে হয় বিছানা ছেড়ে গেছে। যাবার আগে ফ্যানটা বন্ধ করে দিয়ে যাবে না? বেআক্কেল মেয়ে মানুষ। মাথায় ঘিলু বলতে কিচ্ছু নাই। আবার বিড়ালের বাচ্চাটা ডাকছে। মিউ মিউ মিউ। মনে হয় শীতে বাচ্চাটা কাবু হয়ে গেছে। গায়ের কম্বলটা টেনে ঢেকে দিলো বাচ্চাটাকে। আরামে শুয়ে থাক বাবা। যন্ত্রণা করিস না। রান্নাঘর থেকে পানির কল ছাড়ার আওয়াজ আসছে। থালা বাসনের টুংটাং শব্দ। হঠাত কোন হাড়ি পাতিল হাত ফসকে পড়ার তীব্র শব্দ। ঝন ঝন ঝন। ঘুম ভেঙ্গে গেলো বসন্তর। একটু আরাম করে ঘুমোতেও দিবে না। মুখ থেকে কম্বল সরালো সে।

 

শিথান থেকে আবার ডেকে উঠলো -মিউ মিউ মিউ। মনে পড়লো, তার মোবাইল ফোনের রিং টোন এটা। ফোনটা সে হাতে নেয়। চোখ কচলাতে কচলাতে দেখে। ডাক্তার বাবুর ফোন। বিরক্ত হয়ে ফোনটা দূরে সরিয়ে রাখে। রিসিভ করে না। সকাল সকাল উঠেই আদেশ নির্দেশ শুনতে কার ভাল লাগে? করুক ফোন। লাশ কাটাছেড়া করতে হবে। আর কি? এ তো তার রোজকার কাজ। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে? লাশতো চলনশক্তি ফিরে পায়নি যে পালিয়ে যাবে। প্রতিদিনই আসছে লাশ। লাশকাটা ঘরে। কোনটা হত্যা, কোনটা আত্মহত্যা। যেন মৃত্যুর মিছিল। পোস্ট মরটেমের জন্য কাটাছেড়া করতে হয়। কোনদিন একটা। কোনদিন একাধিক।

 

গতকাল বিকেলে একটা লাশ এসেছে। একটা তরুনীর লাশ। সাথের লোকজন বলছিলো নাকে মুখে বালিশ চেপে করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার আগে নিশ্চয়ই ধর্ষণ করা হয়েছে। সুন্দরী মেয়েমানুষ কেউ শুধু শুধু হত্যা করে? আগে ধর্ষণ করে। কাজ শেষে ধর্ষক সম্বিত ফিরে পায়। অতঃপর নিজেকে রক্ষা করার জন্য হত্যা। এমনটাই দেখা যায়। লাশটির সুরতহাল করতে হবে। সে ছাড়া এই কাজ আর কে করবে? জেলা সদর হাসপাতাল। দ্বিতীয় কোন ডোম নেই হাসপাতালে। একটু ভাব নেয় সে। এই অবেলায় কাজ করা সম্ভব নয়। কাল সকালে দেখা যাবে। লাশকাটা ঘরে লাশটি শুইয়ে রেখে ঘরটি তালাবন্ধ করে রেখে যায়। লাশের স্বজনদের অনুনয় বিনয়ে পাত্তা দেয় না।

 

আসলে ভদ্দরলোক মানুষগুলোকে বাগে পেলে একটু বাজিয়ে নেয় বসন্ত। ডেডবডি সাথে নিয়ে এখানে এলে সব বাবুই কাবু। কতো অনুনয় বিনয়। অথচ অন্যসময় সে সমাজে অচ্ছুৎ। তাকে দেখলে নাক সিটকায় সবাই। কেউ ভালভাবে কথা বলে না। এমন ভাব দেখায়, যেনো সে মানুষ নয়। তার একটু ছোয়া লাগলেই যেন বাবুদের জাত যায়। তাই এমন মওকা পেলে সেও খেল দেখাতে ছাড়ে না। যতো বেশী ভদ্দরলোক ততো বেশী খেল। যেমন, একটি লাশ কাটাছেড়া করে সুরতহাল হলো। তখনও সেলাই করা বাকী। এ অবস্থায় লাশ ফেলে রেখে হাত ধুয়ে বেড়িয়ে পড়ে সে। এখন চা নাস্তা খাবে। ধুমপান করবে। ঢিলেঢালা গা-ছাড়া ভাব দেখায়। স্বজনদের জানিয়ে দেয়, ডেডবডি সেলাই করতে সময় লাগবে। অথচ, এমন সময় খুব তাড়াহুড়ো থাকে স্বজনদের। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশ বাড়ী নিয়ে যেতে হবে। সৎকার করতে হবে। জীবিত যে মানুষটার কদরের কোন অভাব ছিলো না, মরে গেলেই সব শেষ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদেয় করো। পুড়ে ফেলো অথবা কবর দাও। এ অবস্থায় সবাই তাকে অনুনয় বিনয় করে। তারাতাড়ি লাশ সেলাই করে রিলিজ দিতে অনুরোধ করে। তখন মজা নেয় সে। তাচ্ছিল্যর সহিত বলে-

যান না। ডাক্তার বাবুকে বলুন গিয়ে সেলাই করে দিতে।

লাশের স্বজনদের কোন একজন জানায়- এটাতো ডাক্তার বাবুর কাজ না। ডাক্তাররা লাশ কাটাছেড়া করতে পারেন না।

সে হুংকার দিয়ে বলে- পারেন না? কেনো পারেন না? সারাদিন এই ওটি থেকে সেই ওটি, এই ক্লিনিক থেকে সেই ক্লিনিক ঘুরে বেড়ান তারা। অপারেশনের পর অপারেশন। জলজ্যান্ত মানুষ কাটাছেড়া করেন। কারো পেট, কারো বুক, কারো মাথা, কারো চোখ। জ্যান্ত মানুষ কাটাছেড়া করায় কোন সমস্যা হয়না তাদের। সমস্যা যতো মৃত লাশের বেলায়। ডাক্তার বাবুরা লাশ কাটেন না। কারণ ওতে কোন লাভ নাই। এখন যদি বলি আমারও লাভ নাই। আমি পারবো না।

এমন সময় ভদ্দরলোকগুলো কাচুমাচু করতে থাকে। ফিসফিস করে বলে- কাজটা শেষ করে দাও ভাই। তোমাকে খুশি করে দেবো।

মনে মনে হাসে। ওষুধে ধরেছে- বুঝতে পারে। দাম হাকে তখন। শালার ভদ্দরলোক! যাবে কোথায়!  

আবার ফোন বাজে “মিউ মিউ মিউ” করে। ডাক্তার বাবুর ফোন। এবার ধরে সে-

স্যার, মাত্র ঘুম ভাংলো। কাল রাতে শরীরটা ভাল যাচ্ছিলো না। ঘুমাতে দেরি হয়ে গেছিলো। আমি একটু রেডী হয়েই আসছি। হ্যা, তাড়াতাড়িই আসছি।

 

বিছানা ছেড়ে বেশ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয় বসন্ত। প্রাতরাশ সারে। আয়েশ করে ধুমপান করে। সিগারেটের শেষ টুকরোটিতে সূখটান দিয়ে ছুড়ে ফেলে। হেলেদুলে আসে লাশকাটা ঘরের দিকে। ডাক্তারসহ লাশের স্বজনরা উদগ্রীব হয়ে আছে তার জন্য। বড় ডাক্তার বাবুও উপস্থিত। অনুমান করে সে। পার্টি বেশ হোমরা চোমরাই হবে। সে নিজেও যে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় তা বুঝানোর জন্য উপস্থিত স্বজনদের তিরস্কার করে-

সবাই মর্গের সামনে ভীর করে আছেন কেনো? এখানে কি কোন সিনেমা হচ্ছে? সরেন সবাই।  সরেন। দূরে গিয়ে অপেক্ষা করেন। কাজ শেষ হতে অনেক সময় লাগবে।

বড় ডাক্তার বাবু এগিয়ে আসেন- তাড়াতাড়ি শুরু করো বসন্ত। লাশ অনেক দূরে যাবে। ছয় সাত ঘন্টার রাস্তা। যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে যে। দাফন করবে কখন?

 

বসন্ত ডোম একটু নমনীয় হয়। বড় ডাক্তার বাবুকে খুব মান্য করে সে। অমায়িক মানুষ। সময়ে অসময়ে এই ভদ্দরলোক অনেক সহযোগীতা করে তাকে। তার পরিবারের ভালমন্দের খোজ খবর নেয়। এতো বড় ডাক্তার, কিন্তু কোন অহংকার নাই। খুব ভাল লাগে তার। সে হুংকার দেয় তার এসিস্ট্যান্ট এর প্রতি-

হালার পুত। এক বালতি পানি অইন্যা রাখতে পারলি না? এটাও আমার বলে দিতে হবে? হালা আকাইম্মার ঢেকি। তোরে দিয়া কিচ্ছু হবে না।

 

এসিস্ট্যান্ট দৌড়ে যায় পানি আনতে। বসন্ত ডোম তালা খুলে লাশকাটা ঘরের। ডাক্তারসহ একসাথে ঢুকে সেই ঘরে। টেবিলে শায়িত নিরব নিথর দেহ। সাদা চাদরে ঢাকা। চাদরের ফাঁক গলে পা দু’টি বের হয়ে আছে। সকালের সূর্যের আলোয় পা দুটি ঝলমল করে উঠে। কী ফর্সা ধবধবে পা! মেয়েটির বয়স অল্প। চাদর সরিয়ে লাশের মুখ বের করে সে। মিষ্টি মায়াবী চেহারা। ঠোট দু’টো সামান্য ফাঁক করা। যেনো কোন গোপন তথ্য বলে যেতে চায় কানে কানে। মুখে একটা স্বর্গীয় হাসির আবেশ ছড়ানো। একটু যেন চেনা চেনা লাগে বসন্তর। মনে করতে পারে না। অবশ্য কিছু কিছু চেহারা এমনই থাকে। দেখলেই চেনা চেনা লাগে। ডাক্তার বাবুর কথামতো লাশের গায়ের চাদর সরায় বসন্ত। লাশের গায়ে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। নখের আঁচড় নীলাভ কালচে কলঙ্ক হয়ে ফুটে আছে। বুকে, তলপেটে, উরুতে, নিতম্বে। ডাক্তার বাবু নোট নেয়। মেয়েটির কপালের নির্দিষ্ট স্থানে ধাতব হাতিয়ারটি বসায় বসন্ত। হাতুরি দিয়ে একটু টোকা দেয়। কট করে মাথার খুলিটা খুলে যায়। ঝিনুকের মতো। বের হয়ে আসে মগজ। এরপর চাকু দিয়ে একটানে বুক থেকে পেট অবধি ফুঁড়ে দেয়। নাড়ীভুঁড়ি বেড়িয়ে আসে। পরীক্ষা নীরিক্ষা চলে। বসন্ত ডোম একটু অন্যমনষ্ক। সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ একটা মেয়ে। সামনে পড়ে ছিলো বিশাল জীবন। সুখদুঃখ, আনন্দ-বেদনা মিলিয়ে যে জীবন মানুষের। অপার সম্ভাবনার। এই মেয়েটিই হতে পারতো একটি জাতির, একটি সমাজের নিদেনপক্ষে একটি পরিবারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন। একেকটি জীবন পৃথিবীতে আসে কী বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে। অথচ কতো সহজেই এই সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করে দেয়া যায়। অসীম সম্ভাবনা গলা টিপে হত্যা করা যায়। এমন সময় হঠাত কথা বলে উঠে মিষ্টি একটা কিশোরী কন্ঠ-

ভাইয়া, একটু পানি দিবে?

চমকে তাকায় বসন্ত। না, লাশতো আগের মতোই আছে। নিরব নিথর। তাহলে কথা বললো কে? মনের ভুল? কিন্তু, সেতো স্পষ্ট শুনেছে। দীর্ঘ সতের বছরের অভিজ্ঞতা তার। হাজার হাজার লাশ কাটাছেড়া করার অভিজ্ঞতা। ছোট-বড়, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। এমন ভুল আগে কোনদিনতো হয়নি। অপলক তাকিয়ে থাকে লাশের মুখের দিকে। সেই মুখে কোন ভাবান্তর নেই। আগের মতোই। যেন অসভ্য এই সমাজকে তাচ্ছিল্য করে মিটিমিটি হাসছে। আবার স্পষ্ট উচ্চারণ-

বসন্ত, বলছি একটু পানি দাও। হাত ধুবো।

বুঝতে পারে সে। ডাক্তার বাবু হাত ধুবার পানি চাচ্ছে। কিন্তু সেই মিষ্টি ডাক? ভাইয়া? ডাক্তার বাবু নিশ্চয়ই তাকে ভাইয়া বলে ডাকেননি। খুবই অচেনা একটি ডাক বসন্তের জন্য। ভাইয়া। হ্যা, একসময় শুনতো। একটামাত্র বোন ছিলো তার। ছোটবোন। খুব আদুরে। কথায় কথায় অভিমান করতো। গলা জড়িয়ে আবদার করতো। কচি কন্ঠে মিষ্টি করে ডাকতো ভাইয়া বলে। কিন্তু, সেতো মারা গেছে অনেক দিন আগে। গণধর্ষণের শিকার হয়ে। অসভ্য পিশাচগুলো হয়তো ধর্ষনের পর হত্যাচেষ্টাও করেছিলো। রক্তক্ষরণ থামানো যাচ্ছিলো না কিছুতেই। অনেক চেষ্টা করেছে বাঁচাতে। কয়েক ঘণ্টা যমে মানুষে টানাটানি। তারপর সব শেষ। বোনটি চলে যাবার পর আর কোনদিন সে ‘ভাইয়া’ ডাক শুনেনি। বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠে বসন্তর। মাথায় একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে। এক বিশাল শুন্যতা গ্রাস করে তাকে। স্থির থাকতে পারে না। শরীর খারাপ লাগে। এসিস্ট্যান্টকে নির্দেশ দেয় লাশটা সেলাই করে দিতে। এই লাশের গায়ে সে নিজ হাতে সুঁই বিঁধাতে পারবে না। অসম্ভব। দীর্ঘ সতের বছরের অভিজ্ঞতা এখানে অচল। তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে যায় বসন্ত। পালিয়ে যায়। পেছনে পড়ে থাকে লাশকাটা ঘর। আর নিস্প্রান দেহ নিয়ে এক কিশোরী। ছোটবোন। বুকে তার পানির তৃষ্ণা। তৃষ্ণা বসন্তর বুকেও। ভীষণ তৃষ্ণা।