চোখ ছলছল করে

গায়ে পড়া মানুষদের সহ্য করা খুব কঠিন। এরা অযাচিতভাবে গল্প করতে পছন্দ করে। চেনা অচেনা নির্বিশেষে। বেশিরভাগই তাদের ব্যক্তিগত অপ্রয়োজনীয় গল্প। যাকে গল্প শোনানো হচ্ছে তার কোন আগ্রহ আছে কিনা সে বিষয়ে এদের কোন মাথাব্যাথা নেই। গল্প বলাতেই এদের সব আনন্দ। এসব গল্পে ভদ্রতাবশত আগ্রহ দেখালেই পড়তে হয় বিপাকে। গল্প শাখা প্রশাখা বিস্তার করে। কাহিনী দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। বকবকানিতে একসময় কান ঝালাপালা করে। মাথা ঝিমঝিম করে। জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। অন্যমনস্ক ভাব দেখানো, আকারে ইংগিতে অনাগ্রহ প্রকাশ - কোন কিছুই এরা তোয়াক্কা করে না। এদের কাছ থেকে উদ্ধার পাওয়ার সহিংস পথ হচ্ছে কঠিন ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়া। এ কাজটি বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব হয় না। ভদ্রতাবশত। এমন সব মহাত্মা পন্থীদের জন্য অহিংস উপায়ও আছে। হঠাত জরুরী কোন কাজের কথা মনে পড়েছে এমন ভাব দেখিয়ে কেটে পড়া। অথবা ভীষণ ক্লান্ত ভাব দেখিয়ে চোখ বুজে ঘুমের ভান করা। সম্ভব হলে শব্দ করে নাক ডাকা। 

সদরুল সাহেব এই মুহূর্তে বেশ বিপদে আছেন। রাত আটটার উপরে বাজে। বসে আছেন একটা দূরপাল্লার বাস কাউন্টারে। ব্রাহ্মপল্লী রোড, ময়মনসিংহ। সুনামগঞ্জগামী বাসের অপেক্ষায়। বেশ বিরক্ত তিনি। নিজের উপর ভীষণ রাগও হচ্ছে। কেন যে লোকটির সাথে কথা বলতে গেলেন। তিনি অবশ্য আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যান নি। লোকটিই আগ বাড়িয়ে তার পরিচয় জেনেছেন। নিজের পরিচয়ও দিয়েছেন। নাম ওমর ফারুক। মহান খলিফা ওমর ফারুকের নামে নাম। একটি এনজিওতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন সুনামগঞ্জে। বাড়ী জামালপুর জেলায়। শুক্র-শনি দু’দিন সরকারি ছুটির সাথে দুর্গা পুজোর একদিনের ছুটি যুক্ত হয়ে মোট তিনদিনের ছুটি। ওমর সাহেব ছুটিতে এসেছিলেন ময়মনসিংহে। ছুটি শেষে আজ কর্মস্থলে ফিরছেন। সাদামাটা চেহারা। নিতান্তই গোবেচারা। এমন একটি লোকের অনর্গল কথা বলার মতো এমন প্রাণশক্তি থাকতে পারে ভাবাই যায় না। গল্প কথায় ভদ্রতাবশত প্রথম প্রথম অনিচ্ছাকৃত হু-হা করে সায় দিচ্ছিলেন সদরুল সাহেব। খানিক পরই টের পেলেন তিনি ভুল করেই বসে আছেন। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। মহান খলিফার নামে নাম হলেও খলিফার মতো মিতভাষী হওয়ার বিরল গুণটির কানাকড়িও বিদ্যমান নাই লোকটির মধ্যে। অনাবশ্যক বকবক করেই চলেছেন বিরামহীন। দেশ, জাতি, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি। কোনকিছুই বাদ যাচ্ছে না। তাকে জ্ঞানের বঙ্গোপসাগর বললে কম বলা হবে। নিদেনপক্ষে ভূমধ্যসাগর না বললে তার জ্ঞানের প্রতি অবিচারই করা হবে। অল্প সময়েই সদরুল সাহেবের মাথা ধরে গেলো। বিরক্ত হয়ে এখন তিনি মুক্তির উপায় খুঁজছেন। হু-হা করে ভদ্রতাও দেখাচ্ছেন না আর। তবুও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই লোকটির। অনবরত বেজেই চলছে রেকর্ড। তিনি টের পাচ্ছেন, গাড়ী ছাড়তে আর কিছুক্ষণ বিলম্ব হলে অন্যরকম কিছু ঘটতে পারে। কাল ভোরে বাস থেকে নেমে তিনি নিজেকে হয়তো সুনামগঞ্জ এর পরিবর্তে পাবনা বা অন্য কোথাও দেখতে পাবেন।  

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি। শহরের রাস্তাঘাট হাটু পানিতে তলিয়ে গেছে। জরুরী কোন কাজের ভান করে সরে যাবেন এমন উপায় নাই। কাউন্টার থেকে বের হলে নির্ঘাত বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। দীর্ঘ দশ ঘন্টার বাস জার্নি। ভেজা জামা কাপড়ে রাতটা কাটানো নিশ্চই কোন কাজের কাজ হবে না। তাছাড়া বাস ছাড়তে মনে হচ্ছে বেশ বিলম্ব হবে। আজ বিজয়া দশমী। থেকে থেকে ঢোল বাদ্য বাজিয়ে ট্রাকে করে আসছে প্রতিমা। সারা শহর থেকে। মিছিল সহযোগে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের দিকে। দুর্গতিনাশিনী মাকে বিসর্জন দিবে বলে। কিন্তু সদরুল সাহেবের দুর্গতি নাশ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও যে মায়ের নেই তা স্পষ্ট। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জগামী গাড়ীটি এখনও কাউন্টার অবধি এসে পৌঁছায়নি। তীব্র যানজট ঠেলে কখন আসতে পারবে বলা মুশকিল। জানিয়েছে কাউন্টারের লোকটি। ওয়েটিং রুমে বসে সহযাত্রী মহান খলিফার প্রলাপ শুনে শুনে এ দীর্ঘ সময় কাটানো অসম্ভব প্রায়। লোকটি এই মুহূর্তে কোন কাজে সামনের পান দোকানে গেলেন। অনুমতি নিয়েই। পাঁচ মিনিটের জন্য। এই হলো মোক্ষম সুযোগ। ঘুমের ভান করে তাকে এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম পন্থা মনে করলেন সদরুল সাহেব। একটু অভদ্রতা হয়। কিন্তু এই মহান কথকের হাত থেকে নিষ্কৃতির আর কোন যুতসই পথ তিনি খুঁজে পেলেন না। বেশ আয়োজন করে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন তিনি। 

স্যার কি ঘুমিয়ে পড়েছেন ?

উম্মম, ঘুমোতে আর দিলেন কই। 
সদরুল সাহেব হালকা রসিকতা করার চেষ্টা করলেন। বলা যায় পরোক্ষভাবে কিছুটা অপমান করার চেষ্টা করলেন। ভদ্রলোক সদরুল সাহেবের অপমানে গা করলেন না। বলে চললেন- 

বাবার বাড়ীর খুব কাছাকাছি যেসব মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব ভাল সংসারী হতে পারে না। কারন কি জানেন স্যার?  

এমন অদ্ভুত কথায় মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেন সদরুল সাহেব। কোন উত্তর দিলেন না। মনে মনে এ মসিবত থেকে পরিত্রাণের জন্য দোয়া কালাম পড়ছেন। এতো দেখছি মোবাইল ফোন অপারেটরদের মতো। কথা শুনিয়েই ছাড়বে। মোবাইল কোম্পানীর প্রমোশনাল এসএমএস এখন আর পাবলিক পড়তে চায় না। তাই তারা চালু করেছে ভয়েস কল। পাবলিক তাদের বিজ্ঞাপন না শুনে যাবে কই? ওমর সাহেবের অবস্থাও অনেকটা এমনই। তিনি অবশ্য উত্তরের কোন অপেক্ষা করলেন না। নিজে নিজেই ব্যাখ্যা করলেন তার সদ্য গবেষণালব্দ বিখ্যাত তত্ত্ব-   

বাবার বাড়ীর কাছাকাছি কোন মেয়ের বিয়ে দেয়া হলে তারা বাপের বাড়ীর উপর নির্ভরশীল থাকে। বাবার বাড়ীকে সহজ আশ্রয়স্থল বলে জানে তারা। স্বামীর সংসারের সামান্য কোন বিষয়ে টুকাটুকি হলেই ফুড়ুৎ করে চলে যায় বাবার বাড়ী। ফলে নিজের সংসারে থেকে সমস্যা মোকাবেলা করার মতো মনমানসিকতা তাদের গড়ে উঠে না। নিজের সংসারে শক্ত অবস্থান তৈরী করতে তারা সমর্থ হয় না। ফলে তারা ভাল সংসারী হতে পারে না।  

সদরুল সাহেব এমন কথার কোন প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পেলেন না। বিরক্ত হয়েই তিনি জিজ্ঞেস করলেন- 

হঠাত এ কথা কেনো বলছেন? 

রোহিঙ্গাদের কথা বলছিলাম স্যার। ভেবে দেখুন, মিয়ানমারের স্বাধীনতার সময় থেকে অদ্যাবধি তারা সেদেশে কোন নাগরিক অধিকার পায়নি। এমনকি সেদেশের জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পর্যন্ত তারা পায় নি। অথচ এই দীর্ঘ সময় ধরে চলা বঞ্চনার বিরূদ্ধে তারা কোন জাতিগত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ১৫-১৬ লক্ষ জনগোষ্টী একেবারে কম নয়। একটু চেষ্টা করলেই তারা একটা জাতিগত ঐক্য গড়ে তুলতে পারতো। গড়ে তুলতে পারতো শক্ত প্রতিরোধ। তারা এসবের কিছুই করতে পারেনি। এর কারণ কি জানেন স্যার? কারণ হলো, যখনই তাদের বিরূদ্ধে সেদেশে কোন অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে তখনই তারা দেখতে পেয়েছে বাংলাদেশের বর্ডার খোলা। এক দৌড়ে চলে আসে বাংলাদেশে। এতে করে প্রতিরোধ করার মতো কোন মনোভাবও তাদের মধ্যে জন্ম নেয়নি। 

এভাবে বলছেন কেনো? আমরাও তো ৭১ সালে শরণার্থী হয়ে ভারতে গিয়েছিলাম। তাদের বর্তমান অবস্থা তো আমাদের মতোই। 

না স্যার। তাদের অবস্থা আমাদের মতো নয়। তারা ওইখানে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে আর দলে দলে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। প্রতিরোধের বিন্দুমাত্র চেষ্টা নাই। বাঙ্গালী কিন্তু একাত্তরে পালায়নি। নারী, শিশু, বৃদ্ধ আর তাদের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু তরুণ শরণার্থী হয়ে ইন্ডিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে বটে। কিন্তু বেশীরভাগ সাহসী মানুষই পালায়নি। শক্তিশালী পাকিস্তানী সেনাবাহীনির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়েছে। প্রাণপণে লড়েছে। এক মুহূর্তও পাকিস্তানীদের স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি।  

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সদরুল সাহেবের খুব দুর্বলতা। বিভিন্ন মিডিয়ায় এই অসহায় জনগোষ্ঠির উপর মিয়ানমার সরকারের সামরিক অভিযানের লোমহর্ষক খবর তাকে খুব বিচলিত করে। অসহায় নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ প্রাণভয়ে পালাচ্ছে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে। জল-জঙ্গল, কাদা-মাটি পেরিয়ে মানুষের মিছিল ছুটে আসছে বাংলাদেশের সীমান্তে। শুধু প্রাণ বাচানোর আশায়। অনেককে পশু পাখির মতো গুলি করে মারছে হিংস্র অমানুষের দল। এ এক অসভ্য, অমানবিক পরিস্থিতি। ভীষন মায়া হয় এই অসহায় লোকগুলোর জন্য। তিনি ওমর সাহেবের এমন কথায় খুব বিরক্ত হলেন। মনে মনে ভাবেন- একটা কঠিন ধমক দেয়া দরকার এই লোকটিকে। এমন সময় বেজে উঠে লোকটির হাতের সেলফোনটি। সদরুল সাহেব খুব কৃতজ্ঞতা বোধ করলেন এই যন্ত্রটির প্রতি। আর ওপাশের কলারের প্রতি। কি মোক্ষম সময়েই না ফোনটি বেজেছে। এবার প্রসঙ্গটি পাল্টাবে আশা করা যায়। ওমর সাহেব ফোন ধরলেন-

হ্যালো মিনু। কী হয়েছে? অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলেছে? কী সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে বলো। এখনই মাস্ক পরানোর ব্যবস্থা করো। আর আমাকে কনফার্ম করো। একটা দিন কোনরকমে চালাও মা। আমি ছুটি নিয়ে কাল রাতেই গাড়ী ধরে ফিরে আসবো। কোন চিন্তা করো না। 

ওমর সাহেবকে বেশ বিচলিত মনে হলো। চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। একবার সোফায় বসছেন তো আবার উঠে পায়চারি করছেন। কোন কথা বলছেন না। বেশ অস্থিরতার মধ্যে আছেন বুঝা যাচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার ওপাশের ফোন। সম্ভবত অক্সিজেন মাস্ক লাগানো হয়েছে। এবার তাকে কিছুটা স্বাভাবিক মনে হলেও উৎকণ্ঠা পুরোপুরি কেটেছে মনে হলো না। স্থির হয়ে হেলান দিয়ে বসেছেন পাশের সোফায়। বেশ কিছু সময় কেটে গেলো, কোন কথা বলছেন না। অনর্গল কথা বলা মানুষটির এমন নীরবতা বেশ বেমানান। সদরুল সাহেবের খুব মায়া হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- 

আপনার কেউ অসুস্থ বুঝি? 

ওমর সাহেব একটু ধাতস্থ হয়ে নিলেন। এরপর শান্তভাবে বলেন- 

আমার বড়বোন হাসপাতালে। ময়মনসিং মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আমার একমাত্র বোন। হঠাৎ হার্ট এটাক। ম্যাসিভ এটাক। হাসপাতালে আনা হয়েছে সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। খবর পেয়ে আমি সুনামগঞ্জ থেকে সরাসরি হাসপাতালে। এই তিনদিন আমি হাসপাতালের বাইরে কোন আলো বাতাস দেখিনি। দিনরাত বোনের পাশে থেকেছি। ঘুম নেই। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া নেই। 

আর কেউ নেই দেখাশুনা করার মতো? 

বোনের একটা মেয়ে আছে, মিনু। স্কুলে পড়ে, বাচ্চা মানুষ। কতই বা বয়স! তের কি চৌদ্দ। বোনের স্বামী মারা গেছে অনেক বছর। এই বোনটি ছাড়া পৃথিবীতে আমার আপনজন বলতে আর কেউ নেই। বোনটিরও নিকটজন বলতে শুধুই আমি। এই মুহূর্তে মুমূর্ষু বোনটির পাশে ছোট্ট একটি অবুঝ মেয়ে। ভাবতেই পারছি না। কী যে করি ! কাল অফিসে একটা জরুরী মিটিং। ইডি স্যার আসবেন ঢাকা থেকে। উপস্থিত থাকতেই হবে। কড়া নির্দেশ। না থাকলে চাকরির সমস্যা হতে পারে। তাই ভাবছিলাম মিটিংটা এটেন্ড করেই ছুটি নিবো। কাল রাতেই আবার ফিরতি বাসে ফিরে আসবো। 

সদরুল সাহেব খুব মায়া অনুভব করছেন এই পরিবারটির জন্য। গুরুতর অসুস্থ একজন মহিলা। পাশে দেখভাল করার গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত ছোট্ট একটি স্কুল-পড়ুয়া বাচ্চা মেয়ে। ভীষণ বিপদে আছে পরিবারটি। কি সান্ত্বনা দিবেন বুঝতে পারছেন না। পরম মমতা নিয়ে তাকিয়ে আছেন ওমর সাহেবের দিকে। একটু থেমে ধরা গলায় বলছেন ওমর সাহেব –

জানেন স্যার? আমার জন্মের বছর খানেকের মাথায় আমার মা মারা যান। বোনের বয়স তখন এগারো কি বারো। এতোটুকু একটি মেয়ে কি স্বাভাবিক ভাবেই তার ছোট্ট মা-মরা ভাইটির দায়িত্ব নিয়ে নিলো। মায়ের অভাব কোনদিন বুঝতেই দেয় নি। কোলে পিঠে করে আমাকে বড় করেছে। আমার সকল চাওয়া পাওয়া, সাধ আহ্লাদ পুরণ করেছে মায়ের মতোই। অভাবের সংসার আমাদের। কিন্তু সে তার ছোট্ট ভাইটিকে এমনভাবে আগলে রেখেছে যে অভাব কি জিনিস আমি ছোটবেলায় কোনদিন বুঝতেই পারিনি। তাইতো আমি মনে মনে তাকেই আমার মা বলে জানি। খুব ছোটবেলার একটি ঘটনা। আমাদের বাড়ীর সামনের আমগাছটায় একটা শালিক পাখির বাসা ছিলো। পাখির বাসা হতে শালিকের ছানা ধরে আনার জন্য আমি বোনের কাছে বায়না ধরি। বোন আমাকে কতো ভাবে বুঝাচ্ছে যে এতো উচু গাছে সে উঠতে পারবে না। পড়ে গেলে হাত পা ভাঙবে। তারপরও আমি নাছোড় বান্দা। বুঝতে চাইছিলাম না। ঘ্যান ঘ্যান করেই চলেছি। কোন উপায় না দেখে বোনটি আমার গাছে উঠলো। কিন্তু পাখির বাসায় হাত দেয়ামাত্র ডাল ভেঙ্গে হুড়মুড় করে নীচে পড়ে গেলো। সেবার হাত ভেঙ্গে এক সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। তখন অবশ্য বাবা বেচে ছিলেন। আমি তার বিছানার পাশে বসে বলেছিলাম- খুব ব্যাথা হচ্ছে আপু? আমি আর কোনদিন পাখির বাচ্চা চাইবো না। আপু স্মিত হেসে বললেন- হাতটা একটু সেরে নিক, শালিক নয়, আমি তোর জন্য ময়না পাখির বাচ্চা যোগাড় করে দেবো। আপু তার কথা রেখেছিলেন। 

ওমর সাহেব তার ছেলেবেলার কথা বলছেন। তার চোখ ছলছল করছে। মাঝে মাঝে মুখটা একটু আড়াল করে চোখের জল মুছছেন। তার গলা ধরে আসছে। এমন সময় আবার ফোন এলো। ওপাশ থেকে কেউ কিছু বলছে। বুঝা যাচ্ছে না। শুধু দেখা গেলো এতক্ষণ বকবক করা লোকটি এক ঝটকায় উঠে দাড়ালো। কানে ফোন রেখেই তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে পড়লো। এলোপাথারি পা ফেলে। হাউমাউ করে কাঁদছে আর ফোনে বলছে- 

হায় আল্লাহ ! এমন কেন হলো ? আমার বড়াপুর সাথে আর কথা হবে না ! আমি এক্ষুনি আসছি মা। কান্দিস না। কান্দিস নারে মা। আমি আসছি।  

ঝুমঝুম বৃষ্টিতে রিক্সা খুঁজছেন ওমর ফারুক। পিছু পিছু গিয়ে একটা রিক্সা পেতে সাহায্য করেন সদরুল সাহেব। পরম মমতায় হাত ধরে রিক্সায় তুলে দেন তাকে। চাকায় পানি ছিটিয়ে এগিয়ে চলে রিক্সা। মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। হারিয়ে যান ওমর ফারুক অনেক মানুষের ভীরে। সদরুল সাহেব আকাশের পানে তাকালেন। তার চোখ ছলছল। তীব্রঘন বর্ষণ ভেজাতে পারেনি যে চোখ, অজানা অচেনা এক বিপদগ্রস্থ পরিবার কত সহজেই তা ভিজিয়ে দিলো!