শাঁকচুন্নি

গলির মুখেই ফজলু ভ্যারাইটিস স্টোর। স্টোর বলতে একটা টিনের ছাপড়া আর ভ্যারাইটি বলতে আছে চা, পান, বিড়ি-সিগারেট আর বাচ্চাদের জন্য কিছু চিপস ও সস্তা চকলেট। সামনে একটি কাঠের বেঞ্চি পাতা। পান সিগারেট কিনতে যারা আসে তাদের বসার কোন প্রয়োজন হয় না। পিক এন্ড পেইড। তবে যারা চা খেতে আসে তাদের একটু বসতে হয়। বেঞ্চিতে বসে সিগারেট টানছে টিপু সুলতান। শুধু সিগারেট খাওয়ার জন্য হলেও তাকে বসতে হয়। বন্ধু রুমিদের বাসায় যাবার প্রাক প্রস্তুতি। এখান থেকে ঠিক তিনটি বাসা পরেই রুমিদের বাসা। ওদের বাসায় সিগারেট খাওয়া দন্ডনীয় অপরাধ। সিগারেট দেখলেই রুমকির মেজাজ চরমে উঠে যায়। রুমকি হলো রুমির ছোটবোন। এ বছর অনার্সে ভর্তি হয়েছে। এই পুঁচকে মেয়েটাই এমন আলিশান বাড়ির জাঁদরেল কর্ত্রী সেজে বসে আছে। রীতিমত স্বৈরাচার। বাসার সমস্ত কিছু চলে তার নির্দেশে। এমনকি রুমিও। সব কিছুর মূলে অবশ্য রুমিই। আদর দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে এক্কেবারে মাথায় তুলেছে। ভাবা যায়, এইটুকু মেয়ে মুখ থেকে জোর করে সিগারেট টেনে নিয়ে কমোডে ফেলে দেয়? এমনকি পকেটে সিগারেটের প্যাকেট লুকানো থাকলেও শুটকি মাছের মতো গন্ধ পৌঁছে যায় তার নাকে। পকেট থেকে টেনে বের করে সিগারেটের গুষ্টি উদ্ধার করে। বড়ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে সামান্যতম সমীহও পাওয়া যায় না। ভীষন বজ্জাত মেয়ে। কতবার সে বুঝিয়েছে, পাবলিক প্লেসে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। কিন্তু বাসাতো পাবলিক প্লেস না। তাছাড়া এ বাসায় কোন মুরুব্বিও নাই। তাহলে এখানে সিগারেট খেতে অসুবিধা কোথায়? কিন্তু সোজা সাপটা জবাব তার- আপনার মতো মানুষ যে স্থানেই অবস্থান করে, সেটাই পাবলিক প্লেস। সুতরাং নো স্মোকিং। অগত্যা রুমিদের বাসায় ঢোকার আগেই ফজলু মিয়ার বেঞ্চে বসে সুখটানটুকু দিয়ে যায় টিপু।

ফজলু স্টোরের স্বত্বাধিকারী মোঃ ফজলু মিয়া সটান বসে আছেন তার দোকানে। পরনে সাদা পাঞ্জাবী। ভীষণ ফুরুফুরে মেজাজ। ঠোঁটে পরিতৃপ্তির হাসি। হঠাত হাসিটি মিলিয়ে গিয়ে বিরক্তির আভাষ তার মুখে। ছাপড়ার পেছনের পর্দার ফাকে মুখ বাড়িয়ে হুংকার দেয়-

অতো দেরি হইতাছে ক্যান? টিপু ভাইজান আইছেন দেখতাছস না? তবদা মেয়েছেলে। কুনু কান্ডজ্ঞ্যান নাই। আরে, তোর পোলার পরীক্ষার খবর পত্রিকায় পইড়া তবেই না ভাইজান আইছেন। ভাইজানের কি অতো সময় আছে নাকি?

মনে পড়ে টিপুর। গতকাল এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। এ বছর এ প্লাসের ছড়াছড়ি। ফেইসবুকে সমালোচনার তুফান। শিক্ষানীতির গুষ্টি উদ্ধার করছে একদল। এই এক অদ্ভুত মাধ্যম। কেউ একজন শুধু দু’ অক্ষর লিখে সমালোচনার সূত্রপাতটুকু করতে পারলেই হলো। দেখা যাবে বিষয়টিতে সবাই বিশেষজ্ঞ। ছেলে- বুড়ো, শিক্ষিত- অর্ধশিক্ষিত নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ বিষয়ে। তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলে।

ফজলু মিয়ার ছেলে কাসেম এ বছর পরীক্ষার্থী। নিশ্চয়ই ভালভাবে পাশ করেছে। এ প্লাসই পাওয়ার কথা। মেধাবী ছেলে কাসেম। ছেলেটা গ্রামের স্কুলে ক্লাশ নাইন পর্যন্ত পড়েছে। ক্লাসে ফার্স্ট বয় ছিলো। অভাব অনটন ফজলু মিয়াকে তাড়া করে ফিরছিলো। গ্রামে পৈতৃক ভিটে আঁকড়ে থেকে কোন ভাবেই সংসার আর টানতে পারছিলো না। ধারে দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিলো। শত চেষ্টা করেও আয় রোজগারের কোন পথ করতে পারেনি। অগত্যা ভাগ্যের সন্ধানে শহরে। সপরিবারে। শহরে আসার পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় কাসেমের। ফজলু মিয়া তাকে নিজের দোকানে সহযোগী হিসেবে কাজে লাগিয়ে দেয়। একদিন কাঠের বেঞ্চিটিতে বসলে টিপুর দৃষ্টি পড়ে ছেলেটির উপর। দোকানে বসে বসে বই পড়ছে ছেলেটি। তাও সাধারণ কোন গল্পের বই না। পড়ছে জাফর ইকবাল স্যারের লেখা “ বিজ্ঞান ও গণিত সমগ্র।“ নিরস বিজ্ঞান আর গণিতের প্রতি ছেলেটির আগ্রহ বুঝাই যায়। উৎসাহী হয়ে উঠে টিপু। মেধাবী আর বিদ্যানুরাগী একটা ছেলের শিক্ষাজীবন এতো অল্পতেই থেমে যাওয়া ঠিক না। কে জানে, এই কাসেমের ভিতরেই হয়তো সুপ্ত আছে একজন আইনস্টাইন। ফজলু মিয়াকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কাসেমকে আবার স্কুলে ভর্তি করাতে রাজী করায়। নিজেও সাহায্য সহযোগিতা করে যথাসাধ্য। কাসেম ভর্তি হয় মহল্লার একটা স্কুলে। মাঝেমধ্যে তার পড়াশুনার খোঁজ খবরও নেয় টিপু। সূযোগ হলে একটু পড়া দেখিয়েও দেয়। ছেলেটা মেধাবী, সন্দেহ নাই। ভাল রেজাল্টই করবে এমনটা আশা করাই যায়।

একটা প্লেটে কয়েকটা মিষ্টি আর এক গ্লাস পানি নিয়ে হাজির হয় ফজলু মিয়ার বউ। মাথায় লম্বা করে টানা ঘোমটা। সলজ্জ সালাম দেয় টিপুকে। মিষ্টির প্লেট রাখে সামনে। ফজলু মিয়া আবার হুংকার ছাড়ে-

হারামজাদাটা গেলো কই? টিপু ভাইজান আসছে দেহে না? ভাইজান না থাকলে তার লেহাপড়া হইতো?

বউটি কোন কিছু বলার আগেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে কাসেম। মুখে রাজ্য জয়ের হাসি। পা ছুয়ে সালাম করে টিপুকে -

স্যার, আমি এ প্লাস পাইছি।

সস্নেহে ছেলেটার মাথায় হাত বুলায় টিপু। মনে মনে খুব তৃপ্তি বোধ করে সে। কিছুটা গর্বও। এক টুকরো মিষ্টি মুখে দিতে দিতে বলে- এখন কোন কলেজে ভর্তি হতে চাও এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করো। আমি পরে এক সময় এসে এ বিষয়ে কথা বলবো।

গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহ। বাইরে কড়া রোদ পিচের রাস্তাটিকে যেন জ্বলন্ত কড়াই বানিয়ে রেখেছে। চতুর্দিকে গাছপালাবিহীন ন্যাড়া ইট কনক্রিটের ঠাসা দেয়ালগুলো থেকে ভাপ উঠছে। সমস্ত প্রকৃতিই যেনো তেঁতে উঠেছে। তাড়াতাড়ি পা ফেলে রুমিদের গেটের ভেতর ঢুকে পড়ে টিপু। দরজায় ছিটকিনিতে কটকট শব্দ করে। সাথে সাথেই দরজাটা খুলে যায়। দরজা খুলে সামিনে দাঁড়িয়ে রুমকি। পরনে কমলা রঙের সুতির শাড়ি। মাথায় আলতো করে ঘোমটা। চোখে চশমা। টিপু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করে-

কিরে? দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলি নাকি? এক টোকাতেই খুলে দিলি যে?

রুমকি সত্যি সত্যি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার মন বলছিলো আজ টিপু ভাই আসবেন। একটু পরপরই বারান্দায় গিয়ে দেখে আসছিলো। প্রায় প্রতি শুক্রবারেই তিনি আসেন। তাদের সাথে দুপুরের খাবার খান। তারপর বিকেল গড়িয়ে ফিরে যান। বড়ভাই রুমির বাল্য বন্ধু। স্কুল, কলেজ একসাথে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়েও একসাথে, একই ন্সাবজেক্টে। পাশ করে বেরিয়েছে বছর দু’এক হবে। রেজাল্ট খুব ভাল। ফার্স্ট ক্লাস। কিন্তু কোন চাকরি বাকরি হচ্ছে না বেচারার। একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিয়েই যাচ্ছেন। ভীষণ সাদাসিধা মানুষ। রুমকিকে ভয় পায় যমের মতো। টিপুর ধারণা এ মেয়ের মাথায় সমস্যা আছে। কোন সময় কি বলে বসে তার নাই ঠিক। আসলে তা সত্য না। রুমকি ঠিকই আছে। কেবল টিপু ভাই সামনে থাকলেই তার মাথা ঠিক থাকে না। উল্টাপাল্টা আচরণ করে। এই যেমন টিপু ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে তার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে-

মহারাজ টিপু সুলতান আমাদের ছোট্ট কুঠিরে পদধূলি দিচ্ছেন, আর আমি অতি সামান্য প্রজা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো না? গর্দান যাবে যে।

একটু থেমে গলায় একটু কাঠিন্য এনে আবার বলে- কতবার বলেছি ভদ্রলোকের মতো কলিং বেল টিপবেন। কিন্তু আপনি তা করবেন না। কটকট করে দরজায় ছিটকিনি বাজাবেন। দরজা ভেঙ্গে ফেলতে চাইবেন। আপনি হচ্ছেন মহীশুরের মহান সম্রাট টিপু সুলতান। ভয়ংকর বলবান পুরুষ। আপনার উপুর্যপরি আঘাতে দরজাটার যাতে কোন ক্ষতি না হয় এ চিন্তায় দরজার খিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি।

টিপু রুমকির দিকে তাকায়। এমন বক্রোক্তিতে তার কাছে নতুন কিছু নয়। পাগলীটা রেগে গিয়েছে কিনা বুঝার চেষ্টা করে। বুঝা যায় না। তাই সত্যি সত্যি রাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করে-

গেট আপ নিয়েছিসতো দেখছি দ্যা গ্রেট বেগম রোকেয়ার মতো। কিন্তু মেজাজটা করে রেখেছিস তিরিক্ষি। এতে বেগম রোকেয়াতো সুদূর পরাহত, তেতুল গাছের শাঁকচুন্নির চেয়েও জঘন্য লাগছে তোকে।

এমন আক্রমনের জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলো না রুমকি। রুমকি দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলায়। মেজাজ ঠান্ডা রাখে। তবে মন খারাপ হয় খুব। তার শ্যামলা বর্ণের মায়াবী মুখটা আরেকটু মলিন হয়। নিজের রূপ লাবণ্য নিয়ে উপহাস করলে কোন মেয়ে কি মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে? এমনিতে সে আহামরি সুন্দরি না ঠিক। তবে একেবারে ফেলনাও নয়। সাজুগুজো পছন্দ করে না। একটু সাজুগুজো করলে তাকে সুন্দরীই বলতে হবে। যেদিন টিপু ভাই আসবে বলে মনে হয় সেদিন সামান্য একটু সাজে। এই যেমন, একটু যত্ন করে গুছিয়ে শাড়ি পরা, মুখে হালকা একটু প্রসাধনী ব্যবহার করা। এই আর কি। একটু যদি এটেনশন পাওয়া যায় মানুষটির। অথচ তার দিকে সামান্য ভ্রুক্ষেপও নাই তার। প্রশংসা সূচক কিছুতো বলেই না, উল্টো আরও মন খারাপ করে দেয়। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে রুমকি বলে-

আপনার আশপাশ ঘিরে এতো এতো হুর-পরী। এদের মধ্যে আমার মতো একটা শাঁকচুন্নি থাকলে কি এমন ক্ষতি?

একটু থেমে উষ্মার সাথে আবার বলে- ভাইয়া কাঁচাবাজারে গেছে। আসতে মনে হয় একটু সময় লাগবে। আপনি বসার ঘরে একটু বসুন। বুয়াকে চা দিতে বলছি।

মনে হয় সত্যি সত্যি রেগে গেছে মেয়েটা। তা না হলে বুয়াকে দিয়ে কখনও চা পাঠায় না সে। নিজেই চা পরিবেশন করে। পাগলীটার মুডটা একটু চেঞ্জ করা দরকার। রুমকির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে-

আজ দুপুরে কিন্তু খেয়ে যাবো। তোর হাতের রান্না অসাধারণ। এ উপমহাদেশে তোর মতো ভালো রান্না আর কেউ করে না। এসেই যখন পড়েছি, এমন রান্না মিস করা ঠিক হবে না।

এবার একটু নরম হয় রুমকি - তাই? আজও নিশ্চয়ই বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন চাচা?

এমন কথায় অপ্রস্তুত হয় টিপু- তুই কি করে জানলি?

এবার মুখে মৃদু হাসি- সে আর এমন কি কঠিন? বেশ কিছুদিন যাবত এমনই হচ্ছে। চাচা প্রায়ই আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। আপনার ছোটবোন নিতু কাছ থেকে নিয়মিত আপনার আপডেট পাই। নিতু আমার ভক্ত। ঠিক আছে, আপনার মতো একজন আশ্রয়হীন মানুষকে লাঞ্চের জন্য নিমন্ত্রণ করা হলো। আমি রান্নাঘরে গেলাম। আপনি একটু বসুন গিয়ে।

টিপু ড্রইং রুমে গিয়ে বসে। বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার ব্যাপারটা রুমকিও তাহলে জানে। নিতু জানায়? আর কী কী জানায়? ধমকে দিতে হবে নিতুকে। এটাতো অন্যকে জানানোর মতো সিরিয়াস কোন ঘটনা না। তার বাবা জনাব আব্দুস সোবহান এককালের দাপুটে ইংরেজি শিক্ষক। ভীষণ রাগী। এখন বয়েস হয়েছে। কিন্তু রাগটা মোটেও কমেনি, বরং বেড়ে গেছে। আর মাস ছয়েক পরেই পেনশন। অথচ ছেলেটার কোন ব্যবস্থা হচ্ছে না এখনও। তাই মেজাজ তার প্রায়ই চরমে থাকে। শুক্রবার ছুটির দিন। টিপুর মতো একটা বেকার ছেলে চোখের সামনে ঘুরাঘুরি করে। তার সহ্য হয় না। সামান্য কোন উপলক্ষ্য পেলেই রাগে ফুসতে থাকেন। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে টিপুর উপর। বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেন তাকে। এমন ছেলের মুখ দর্শন করতে চান না তিনি। বাবার এমন আচরণে প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ হতো টিপুর। এখন আর হয় না। সে বুঝে গেছে বাবা তাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি তার প্রিয় সন্তানের এমন অসহায় বেকারত্ব চোখের সামনে সহ্য করতে পারেন না। তাই চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দেন। অথচ, সকালে বাড়ি থেকে বের করে দিলেও বিকেলে তার ফোন- বাসায় ফেরার পথে পাড়ার মহসীনের ফার্মেসী থেকে এক পাতা নাপা নিয়ে এসো। স্পষ্ট বাড়ি ফেরার আমন্ত্রণ। যেনো বাড়ি থেকে বের করে দিলেও দিনশেষে ছেলে বাসায়ই ফিরবে, এটাই স্বাভাবিক।

বসার ঘরে চা নিয়ে ফিরেছে রুমকি নিজেই। টিপুর সামনের আসনে মুখোমুখি বসেছে সে। পরিবারের সবার কুশলাদি জিগ্যেস করছে। তার চাকরীর প্রসঙ্গও উঠে। এক পর্যায়ে টিপু জানায়-

চাকরি বাকরির আশা ছেড়ে দিয়েছি, বুঝলি? ভাবছি, ব্যবসা করবো। এখন হলো ব্যবসার যুগ। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। একটু বুদ্ধি খাটাতে পারলেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। ব্যবসার একটা আইডিয়াও মাথায় এসেছে। রুমির সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করবো ভাবছি।

রুমকি উৎসাহী হয়- কিসের ব্যবসা? আমার সাথে পরামর্শ করা যায় না?

টিপু বেশ ভাব নিয়ে বলে- ব্যবসার তুই কী বুঝবি? তবুও এতো করে যখন জানতে চাইছিস। বলেই ফেলি। ফুলের ব্যবসা। ভাবছি, একটা ফুলের দোকান দেবো। পুঁজি খুব বেশী একটা লাগবে না। লাভও যথেষ্ট।

রুমকি চোখ কপালে তুলে। টিপু বলে চলে- এখন ফুলের অস্বাভাবিক কদর। নেতাকে বরণ করতে ফুল। নেতার জন্মদিনে ফুল, বিয়ে বার্ষিকীতে ফুল। নেতার বউ, ছেলেমেয়ে, স্বজনদের জন্মদিন। নেতা বিদেশ গেলে ফুল। দেশে ফিরলে ফুল। এমনকি নেতা জেল খেটে বের হয়ে এলেও ফুল। শুধু ফুল ফুল আর ফুল। আর নেতার সংখ্যা? দেশে নেতার সংখ্যা সার্ভে করতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও ফেইল। হা হা হা। আর হ্যা, তুইতো ভাল ফুল সাজাতে পারিস। ভাবছি তোকে আমার দোকানে একটা চাকরি দিয়ে দেবো। পার্ট টাইম চাকরি। প্রথম প্রথম বেতন বেশী দিতে পারবো না কিন্তু। আগেই বলে রাখি। ব্যবসা ভাল হলে তখন দেখা যাবে। তুই রাজী তো?

টিপুর ছেলেমানুষিতে রুমকি হাসে- অবশ্যই রাজী। এমন চাকরী কেউ পায়ে ঠেলে? তবে বেতনের বিষয়টা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। অবশ্য আমি আপনাকে একটা ভাল আইডিয়া দিতে পারি। এতে আমাকে কোন বেতনই দিতে হবে না আপনার। পুরোটাই মাগনা। খালি লাভ আর লাভ।

কি আইডিয়া? বল দেখি?

আমাকে আপনি বিয়ে করে ফেলুন।

কথাটা বলে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে যায় রুমকি। লজ্জায় মাথা নত করে দৌড়ে পালায়। রুমের দরজা বন্ধ করে নিজেকে লুকায়। ছিঃ ছিঃ। একি বেফাঁস কথা বলে ফেললো সে। কথাটা তার মনের ভেতর লুকানো ছিলো, তা ঠিক। তাই বলে এমন বেফাঁস ভাবে বেড়িয়ে আসবে তা সে নিজেও ভাবতে পারেনি। নিজেকে ধিক্কার দেয় সে। এমন সস্তাভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা ঠিক হয়নি তার। এখন কেমন করে টিপু ভাইয়ের সামনে মুখ দেখাবে সে?

অপ্রস্তুত টিপুও। হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। রুমকিটা কী? ভাইয়ের বন্ধু ভাইয়ের মতো। তাকে এমন কথা কেউ বলে? মেয়েটা এতোবড় হয়ে গেছে আগে খেয়াল করে দেখেনি সে। ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিলো তাকে। রুমি একথা জানলে তার সম্পর্কে কী ভাববে? এতোদিনের পুরানো বন্ধুত্ব তাদের। এ বন্ধুত্বের কী হবে? সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে কী করবে। চুপি চুপি বের হয়ে গেলে মেয়েটা আপাতত লজ্জার হাত থেকে বাচে, সে নিজেও বাচে। তাই ভালো। বের হতে গিয়েই খএমন সময় রুমি। বাজারের ব্যাগ নামিয়ে রাখে-

- তুই এসেছিস? আমি ভাবছিলাম তোকে ফোন দেবো। ভাল খবর আছে। কোরিয়াতে আমার যে স্কলারশিপটার কথা হচ্ছিল তা ফাইন্যাল। মাস দুয়েকের মধ্যেই চলে যাবো। পেপারস রেডি করছি। আর তোর সিভিটা জমা দিয়েছিলাম আমার ইউনিভার্সিটিতে। তারা তোকে পছন্দ করেছে। আমার পজিশনে ওরা তোকে নিতে রাজী। মুটামুটি ফাইন্যাল। তোর রেজাল্ট ভাল। পছন্দ না করে উপায় আছে? তুই কাল-পরশু একদিন চলে আসবি আমাদের ইউনিভার্সিটিতে। ওরা তোর সাথে কথা বলতে চাইছে।

টিপু নিরুত্তর। তার মাথায় এখন আর কিছু ঢুকছে না। কিছু সময়ের মধ্যে উপুর্যপরি দু’দুটি বড় ধাক্কা সে নিতে পারছে না। তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সব। রুমি পাশে বসে গলা চড়িয়ে ডাকে- রুমকি, চা দিয়ে যা।

দুই বন্ধুর মধ্যে কথাবার্তা চলছে। রুমি একাই বলছে। টিপু শুধু হু হা করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই চা নিয়ে ঘরে ঢুকে কাজের বুয়া। বুয়া জানালো আপা তার রুমে। বিছানায় শুয়ে কাঁদছে।

চিন্তিত হয়ে পড়লো রুমি। তার মা বাবা নেই। একমাত্র বোনটিই তার আপনজন। তার কান্না সে নিতে পারে না। কিন্তু কান্নার কি কারণ থাকতে পারে? টিপুকে জিজ্ঞেস করে- তুই রুমকিকে কিছু বলেছিস? কাঁদছে যে?

মাথা নত করে টিপু উত্তর দেয়- আমি কি বলবো? যা বলার সেই বলেছে?

চোখ কপালে তুলে রুমি- কী বলেছে?

বলেছে, আমি যেন তাকে বিয়ে করে ফেলি?

একটু হোঁচট খায় রুমি। পরক্ষণেই হা হা করে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে- এ কথা তোকে বলেছে রুমকি? আজ বলেছে? আমিতো ভেবেছিলাম অনেক আগেই এ কথা বলা হয়ে গেছে। বুঝা গেলো, মেয়েটা কোন কাজের না। সামান্য একটা বাক্য উচ্চারণ করতে এতোদিন সময় নিলো?

মানে?

মানে হলো, রুমকি তোর প্রতি বেশ দুর্বল তা আমি বেশ কিছুদিন যাবত টের পাচ্ছি। প্রায়ই তোর বিষয়ে আগ্রহ দেখায় আমার কাছে। তোর সম্পর্কে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। একটু ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে। যেমন সেদিন বলছে, টিপু ভাইয়ের মতো ভাল একটা মানুষের লাইফটা এমন কেন হচ্ছে ভাইয়া? কোন চাকরি বাকরি হচ্ছে না। ভীষণ কষ্টে আছে বেচারা। তুমি দেখনা একটা কিছু করতে পারো কিনা। আবার একদিন বলে- তোমার বন্ধুটা এমন ক্ষ্যাত কেনো ভাইয়া? একটু স্মার্ট বানাতে পারোনা? একটু থেমে রুমি আবার বলে - বুঝলি টিপু। তুই হলি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। খুব ছোটবেলা থেকেই তোকে চিনি, জানি। আর আমার বোন বলে বলছি না, রুমকিও একটা অসাধারণ মেয়ে। ভীষণ গোছানো। তোরা দুজন মিলে যদি সিদ্ধান্ত নিতে পারিস, আমি খুশিই হবো। আশা করি তোর বাবাকেও রাজী করাতে পারবো আমি। রুমকি আমার বোন। তাকে তিনি নিশ্চয়ই অপছন্দ করবেন না।

গ্রীষ্মের বিকেল। সূর্যের তেজ কমে এলেও রাস্তার তেজ কমেনি। ভীষণ উত্তপ্ত পথে পা ফেলে টিপু। প্রাথমিক লক্ষ্য ফজলু মিয়ার ভ্যারাইটি ষ্টোর। মাথাটা তবদা মেরে আছে। একটু রিফ্রেশ করতে হবে। দীর্ঘদিনের বদভ্যাস। এ বদভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে। পাগলীটা এসব একদম সহ্য করতে পারে না। টের পাচ্ছে, পেছনের দোতলার বারান্দা থেকে তার দিকে শ্যোন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক শাঁকচুন্নি। রক্তমাংসের এক টগবগে তরুণী। অনেক দিনের চেনা। কিন্তু চোখ মেলে দেখা হয়নি কোনদিন। ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ভয় হয়, পেছন ফিরে তাকালেই যদি শাঁকচুন্নিটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।