ফিরে দেখা  (পর্ব ১)

কম লোকই আছেন যিনি স্মৃতিরোমন্থন করে না, স্মৃতিকাতর হয় না কিংবা স্মৃতিরোমন্থন করতে ভালোবাসে না। স্মৃতি ভান্ডারের মধুর স্মৃতিগুলো মানুষের নিঃসঙ্গ সময়ের উত্তম সঙ্গী। মধুর স্মৃতিগুলো জীবন জুড়ে সুখ-সাথী হিসেবে সঙ্গ দেয় বটে, তবে দুঃখ স্মৃতিগুলো  জীবন চলার পথে ফেলনা নয়। বরং জীবনে খাঁটি হতে, জীবনকে চিনতে-বুঝতে দুঃখ স্মৃতির মূল্যমান সুখ-স্মৃতি অপেক্ষা শ্রেয়। ছাত্রকাল জীবনের স্বর্ণালী সময় বলে শুধু আমি নয় সবাই মানে। ছাত্রকালীন সময়কে ফিরে ফিরে দেখতে আমার বড্ড ভালো লাগে।

ছাত্রকালের কথা ভেবে প্রায়শঃই আমি স্মৃতিকাতর হই এবং নিজের অজান্তেই ছাত্র সময়ের পরতে পরতে বিচরণ করে সুখানুভব করি। বলা বাহুল্য আমার ছাত্রজীবন কখনোই অনেকের মতো বর্নাঢ্য ছিল না কিন্তু বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল অবশ্যই। বলে রাখি, কোন একসময়ে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রজীবনের কাসুন্দি ঘাঁটবো বলে আশা রাখি , এ যাত্রায় নয়। ফিরে দেখার কয়েকটি পর্বে আমি শুধুই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রকালীন সময়ে ব্যক্তি আমাকে ঘিরে থাকা গন্ডি এবং সেই সময়ে আমার পারিপার্শ্বিক মানুষগুলোর দিকে ফিরে ফিরে তাকাবো (উল্লেখ্য, আমার বর্ণনায় কেউ দুঃখ পেলে আমি অধিকতর দুঃখ পাবো )।

আমার স্কুল জীবনের সময়কালে পারিবারিকভাবে আমাদের পরিবার " উচ্চবিত্ত পরিবারের" তকমা পাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। কিন্তু "মধ্যবিত্ত পরিবারের " সন্তান হলেও আমাদের এলাকায় আমার স্কুল শিক্ষক পিতার বিশাল ব্যাপ্তির (জ্ঞানী ও সৎ মানুষ হিসেবে) কারণে আমরা সকল ভাই-বোন এলাকায় বেশ খাতির পেতাম এবং সকলের জন্য অনুকরণীয় ও সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম। আর শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা সকল ভাই-বোন উত্তম ক্যাটাগরিভুক্ত না হলেও উত্তম- মধ্যমের মাঝামাঝির চাইতে উপরের দিকেই ছিলাম আলবৎ।

১৯৮৯ সাল। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হলো, আমি পূর্ব অনুমেয় ফলই পেলাম যা আশাব্যঞ্জক। পিতামাতা ও বড় ভাইদের আগ্রহে পরবর্তী বিদ্যাশিক্ষা স্থানীয় গণ্ডিমুক্ত হয়ে নামকরা কোনো কলেজে করার সিদ্ধান্ত স্থির হলো। স্থিরকৃত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা কলেজ ও রাজশাহী কলেজের ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তির সুযোগে গর্বিত হলাম। রাজশাহী কলেজ শুধু উত্তরাঞ্চলের সেরা কলেজ নয়, বরং দেশের সমগ্র কুলীন প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে প্রাচীন এবং অন্যতম সেরা  কুলীন। উত্তরাঞ্চল ছাপিয়ে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সর্বোচ্চ মেধাবীরা গর্বভরে বিদ্যাশিক্ষার লক্ষ্যে রাজশাহী কলেজে আসতো এবং খুব ভালো ফলাফল করতো। রাজশাহী কলেজের এইচএসসি'র (বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য তিন বিভাগেই) ভালো ফলাফলের রেকর্ড ছিল ধারাবাহিক এবং সর্বেসর্বা। এমন একটি কলেজে পড়তে পারবো ভেবে গদোগদো মনে ক্লাস শুরুর দিনক্ষণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। অপেক্ষার পালা শেষে কাঙ্খিত দিন নিকটবর্তী হলো, আমি যৎসামান্য বাক্স-পেটরা পুঁজি নিয়ে রাজশাহী পৌছুলাম, গন্তব্য উপশহরের পাশে তেরখাদিয়া খালাতো ভাইয়ের বাসা। সিট্ সংকটের কারণে কলেজ ছাত্রাবাসে এইচএসসি প্রথম বর্ষে সিট্ পাওয়ার কোনোই সুযোগ ছিল না। মন স্থির করেছিলাম প্রথম দুই/চার দিন খালাতো ভাইয়ের বাসা থেকেই কলেজে যাবো এবং সুবিধামতো মেস খুঁজে সেখানে উঠে পড়ব।

অবশেষে কলেজ জীবন শুরুর কাঙ্খিত সেইদিন চলে আসলো, ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসের কোনো এক রবিবার। সাধ্যমত সেজেগুজে সকাল ৭ টার মধ্যে উপশহরের তেরখাদিয়া থেকে রওয়ানা হলাম, ৯ টায় প্রথম ক্লাস। উত্তেজনায় ঠাসা আমি কলেজ ক্যাম্পাসে পৌছালাম ঘড়িতে ৯ টা বাজতে ঘন্টা খানেক আগেই। কলেজ জীবনের প্রথম দিন বলে কথা, একি (!) আমার মতো অনেকেই কলেজ ক্যাম্পাসে চলে এসেছে? বিশাল কলেজ ক্যাম্পাস। মুগ্দ্ধ হয়ে দেখছিলাম, সব ছেলেমেয়েগুলোই ভীষণ স্মার্ট, বিশেষ করে মেয়েগুলো, ওরা নিজেরাই কলরব করছিলো-আনন্দের কলরব, উচ্ছাসের কলরব (পরে বুঝতে পেরেছিলাম ওরা রাজশাহীর বিভিন্ন নামকরা স্কুলের সহপাঠী যারা আবার কলেজে একসাথে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল)। ভীষণ স্মার্ট ছেলেমেয়েগুলোর মাঝে আমাকে চলনবলন আর বেশভূষাতে  অনেকটাই বেমানান লাগছিলো যা আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম। তবু মনে সাহস সঞ্চয় করে এদিক -সেদিক হাটছিলাম আর অবাক বিস্ময়ে স্মার্ট ছেলেমেয়েগুলোকে ও কলেজের বিভিন্ন বিল্ডিংগুলো (বিল্ডিংগুলোতে বিষয়ের নাম লেখা ছিল) দেখছিলাম।

ইতোমধ্যেই দেখলাম বেশ স্মার্ট ছেলেমেয়েগুলো নিজেরা নিজেরা পরিচিত হলো। নিজে সাহস করে কোনো মেয়ে তো দূরের কথা ছেলের সাথেও পরিচিত হতে পারলাম না (!), নিজের অযোগ্যতা সহ সাত -সতেরো অনেক কিছু ভাবতে ভাবতেই ঘড়িতে ৯ টা। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে স্মার্ট ছেলেমেয়েগুলোকে অনুসরণ করে কলেজ জীবনের প্রথম ক্লাস রুমে ঢুকে পড়লাম, আগেই জেনেছিলাম আমি "বি" সেকশন এ। ক্লাসে ঢুকতে না ঢুকতেই সহাস্যে মাঝবয়সী অতীব সুন্দরী ম্যাডাম ঢুকে পড়লেন (ম্যাডামের নাম সম্ভবত ফরিদা ম্যাডাম)। ম্যাডাম তাঁর পরিচিতি ও টুকটাক কুশল বিনিময় শেষে "রোল-কল" করতে লাগলেন। আমি অধীর আগ্রহে ম্যাডামের মুখে আমার রোল ১৬৪ শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে কাঙ্খিত মুহূর্ত এলো, আমি অন্যদের দেখে শিখা -yes mam বলে মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম।  .................চলবে।